যে প্রক্রিয়ায় ফায ভাইরাস পোষক ব্যাকটেরিয়া কোষে প্রবেশ করে সংখ্যাবৃদ্ধি করে এবং অপত্য ভাইরাসগুলো পোষক দেহের বিদারণ ঘটিয়ে নির্গত হয় তাকে লাইটিক চক্র বা বিগলনকারী চক্র বলে। Escherichia coli (E.coli) নামক ব্যাকটেরিয়া কোষে T2 ব্যাকটেরিওফাযের লাইটিক চক্র নিম্নলিখিত ধাপসমূহে সংঘটিত হয়।
১. সংযুক্তি বা পৃষ্ঠলগ্নীভবন (Attachment/ Landing) :
T2 ব্যাকটেরিওফাজ সাধারণত Escherichia-coli (E.coli) ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণ করে থাকে। E.coli ব্যাকটেরিয়ামের কোষ প্রাচীরে ফায প্রোটিনের জন্য রিসেপ্টর সাইট (receptor site) থাকে। রিসেপ্টর সাইটের প্রোটিনের সাথে ফায ক্যাপসিডের স্পর্শক তন্তুর প্রোটিনের রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে ব্যাকটেরিয়ামের প্রাচীরে T2 ফাজ দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত হয়ে যায়। এটি হলো আক্রমণের সূচনা।
২. ফাজ DNA অণু প্রবেশ (Penetration) :
ব্যাকটেরিওফাজের দন্ডাকৃতির লেজটি সংকুচিত হয়ে বিশেষ শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সংযোগ স্থানের প্রাচীরে ছিদ্র তৈরি করে এবং ফায-DNA কে E.coli ব্যাকটেরিয়ামের কোষ মেমব্রেন ভেদ করে সাইটোপ্লাজমে প্রবেশ করিয়ে দেয়। শূণ্য প্রোটিন আবরণটি বাইরেই থেকে যায়।
৩. অনুলিপন (Replication) :
ফাজ DNA পোষক কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার পর তার নিজস্ব প্রোমোটার সিকুয়েন্স দ্বারা পোষক কোষের RNA পলিমারেজকে আকৃষ্ট করে। পোষক কোষের RNA পলিমারেজ ব্যবহার করে ফাজ mRNA তৈরি করে। ফাজ mRNA পরে প্রোটিন তৈরি করে এবং একটি বিশেষ প্রোটিন (প্রকৃতপক্ষে এনজাইম) E. coli DNA-কে খণ্ড বিখণ্ড করে নষ্ট করে দেয়। কাজেই পোষক কোষে ফাজ DNA-এর কোনো প্রতিযোগী থাকে না। ফাজ DNA নিউক্লিয়োটাইড (E. coli কোষের বিগলিত DNA থেকে মুক্ত হওয়া) কোষের রাইবোসোম, tRNA, অ্যামিনো এসিড ইত্যাদির কর্তৃত্ব গ্রহণ করে এবং নিজের ইচ্ছেমতো নতুন ফায DNA প্রতিলিপন করে নেয় এবং ফায কোট প্রোটিন (coat protein) তৈরি করে। কোট প্রোটিন মাথা, লম্বা লেজ, স্পর্শক তন্তু, স্পাইক ইত্যাদি অংশ হিসেবে পৃথক পৃথকভাবে তৈরি হয় ।
৪. সংশ্লেষঃ
পোষক কোষের অভ্যন্তরে প্রতিটি ফাজ DNA এক একটি কোট প্রোটিনের মাথার অংশে প্রবেশ করে। পরে ক্রমান্বয়ে মাথার অংশের সাথে লেজ, লেজের শেষ প্রান্তে স্পর্শক তন্তু, স্পাইক ইত্যাদি সংযুক্ত হয়ে পূর্ণাঙ্গ ব্যাকটেরিওফাজ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
৫: নির্গমন (Release) :
পোষক কোষের অভ্যন্তরে প্রচুর সংখ্যক ব্যাকটেরিওফাজ তৈরি হওয়ার পর ফাজ একটি সুনির্দিষ্ট এনজাইম তৈরি করে যার কার্যকারিতায় পোষক কোষের প্রাচীর বিদীর্ণ হয়ে যায় এবং নতুন সৃষ্ট ব্যাকটেরিওফাযসমূহ মুক্তভাবে বেরিয়ে আসে। মুক্ত হওয়া প্রতিটি ফায একটি নতুন E. coli ব্যাকটেরিয়ামকে আক্রমণ করতে সক্ষম। পোষক কোষে বংশগতীয় বস্তু প্রবেশের পর ভাইরাসের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটতে পারে এবং পোষক কোষ ভেঙ্গে অনেকগুলো ভিরিয়ন মুক্ত হয়। ভাইরাসের এ ধরনের সংখ্যাবৃদ্ধি প্রক্রিয়াকে লাইটিক চক্র বলে। যেমন- E. coli আক্রমণকারী T2 ফাজ। এমন প্রকৃতির ফাযকে লাইটিক ফায বা ভিরুলেন্ট ফায (virulent phage) বলে। কোষপ্রাচীর বিদীর্ণ হওয়াকে লাইসিস (Lysis) বা বিগলন বলে। লাইটিক চক্রের মাধ্যমে মাত্র ৩০ মিনিটে প্রায় ৩০০টি নতুন ফায সৃষ্টি হয়ে থাকে। নির্গত নতুন ফায নতুন পোষক কোষে সংক্রমণ সৃষ্টি করে।
পোষক ব্যাক্টেরিয়াকে আক্রমণ করার পর থেকে যে সময় পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ অপত্য ভাইরাস সৃষ্টি না হয় সেই সময় কালকেই ইকলিপস কাল বলে।
যে প্রক্রিয়ায় ফায ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার কোষে প্রবেশের পর ভাইরাল DNA-টি ব্যাক্টেরিয়াল DNA অণুর সঙ্গে সংযুক্ত হয় এবং ব্যাকটেরিয়াল DNA-র সঙ্গে একত্রিত হয়ে প্রতিলিপি গঠন করে কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ভাইরাসরূপে ব্যাকটেরিয়া কোষের বিদারণ বা লাইসিস ঘটিয়ে মুক্ত হয় না তাকে লাইসোজেনিক চক্র বলে। ল্যামডা ফায (λ −ফাজ), P1 ফাজ,M13 ফাজ ইত্যাদি ভাইরাস Escherichia coli (E. coli) ব্যাকটেরিয়া কোষে লাইসোজেনিক চক্র সম্পন্ন করে। এ ধরনের চক্রে ফায ভাইরাস পোষক কোষকে ধ্বংস না করেই সংখ্যাবৃদ্ধি করে থাকে। লাইসোজেনিক চক্রের ধাপগুলো নিম্নরূপ :
১. পোষক ব্যাকটেরিয়ায় সংযুক্তি এবং ফায DNA-এর অনুপ্রবেশ (Attachment to host bacteria and penetration of phage DNA):
লাইটিক চক্রের মতোই প্রথমে ফায ভাইরাস পোষক কোষপ্রাচীরকে ছিদ্র করে DNA অণুকে পোষক কোষে প্রবিষ্ট করায় এবং শূন্য প্রোটিন আবরণটি পোষক কোষের বাইরে থেকে যায়।
২. ব্যাকটেরিয়া DNA এর সঙ্গে ভাইরাস DNA এর সংযুক্তি (Attachment of viral DNA to bacterial DNA):
এ পর্যায়ে নিউক্লিয়েজ এনজাইম ব্যাকটেরিয়ার DNA-কে একটি জায়গায় কেটে ফেলে। এই কাটা স্থানে ফায DNA-টি গিয়ে সংযুক্ত হয়। এ ধরনের সংযুক্তিতে ইন্টিগ্রেজ এনজাইম বিশেষ ভূমিকা রাখে। ব্যাকটেরিয়ার DNA-র সঙ্গে সংযুক্ত ভাইরাস DNA-টিকে প্রোফায (prophage) বলে। এটি ব্যাকটেরিয়ায় সুপ্তাবস্থায় থাকে। ফায DNAসহ Escherichia coli (E. coli) ব্যাকটেরিয়া দ্বি-বিভাজন প্রক্রিয়ায় সংখ্যাবৃদ্ধি বা বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার জিনোম একসাথে একটি নতুন জিনোম তৈরি করে। প্রত্যেকবার সংখ্যাবৃদ্ধির সময় ব্যাকটেরিয়াল DNA-এর অনুরূপ ভাইরাল DNA অণুটিরও প্রতিলিপি গঠিত হতে থাকে। এভাবে প্রতিটি অপত্য ব্যাকটেরিয়ায় ভাইরাস DNA-র একটি কপি সংযুক্ত হতে থাকে। তবে প্রয়োজন হলে পোষক DNA থেকে ফায DNA পৃথক হয়ে লাইটিক চক্রের মাধ্যমে সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটাতে পারে।
লাইটিক চক্র | লাইসোজেনিক চক্র |
---|---|
১. এ প্রক্রিয়ায় কাজ ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া কোষে প্রবেশ করে সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটায় এবং পূর্ণাঙ্গ ভাইরাস গঠিত হয়। | ১. এ চক্রে ফাজ ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া কোষে প্রবেশ করার পর ভাইরাল DNA অণুটি ব্যাকটেরিয়াল DNA অণুর সাথে যুক্ত হয় এবং একত্রিত হয়ে প্রতিলিপি গঠন করে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ভাইরাস সৃষ্টি হয় না। |
২. পোষক ব্যাকটেরিয়া কোষের বিদারণ ঘটে। | ২. ব্যাকটেরিয়া কোষ বিদারিত হয় না। |
৩. T-সিরিজযুক্ত কাজে লাইটিক চক্র দেখা যায় | ৩. (ল্যামডা)- সিরিজযুক্ত ফাজে লাইসোজেনিক চক্র দেখা যায়। |
৪. লাইটিক চক্র একবার সম্পন্ন হলে অনেকগুলো ভাইরাসের সৃষ্টি হয়। | ৪. লাইসোজেনিক চক্র একবার সম্পন্ন হলে মাত্র দুটি ভাইরাস জিনোমযুক্ত ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্টি হয়। |
৫. এ চক্রে ভাইরাসের সংখ্যাবৃদ্ধি ভাইরাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। | ৫. এ চক্রে ভাইরাসের DNA এর সংখ্যাবৃদ্ধি পোষক |